একটি স্টেথোস্কোপ
আমি নাকি ডাক্তারের থার্ড আই, আমাকে বাক্সবন্দি করতে করতে আমার প্রস্তুতকারক তার কলিগকে কথাটা বলেছিলো। এর পর কিছু মনে নেই। ঘুমিয়ে ছিলাম, ঠিক কতদিনের জন্য তা জানি না, তবে এরপর যখন চোখ খুলি তখন দেখি কেউ আমাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে, চোখে চশমা পরা আর খোচা খোচা দাড়িতে মুখভর্তি লোকটাকে আমার এতটুকুও ভালো লাগে নি। আমাকে তৈরি করার সময় যেভাবে মানুষ গুলো ডাক্তার ডাক্তার করতেছিল আমি ভাবছিলাম ডাক্তার হয়তো কোন উন্নতমানের যন্ত্র হবে! কিন্তু এ তো দেখছি মানুষ! ভাবনা শেষ করতে পারলাম না, তার আগেই হুট করে আমাকে নিজের গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে বলল, এই দেখ আমার নতুন স্টেথো! ঝুলে ঝুলে দেখলাম আরো ২ জন আমাকে দেখছে আমি বুঝলাম এরাও হয়ত ডাক্তার টাইপ কিছু হবে, কিন্তু এরা সবাই দেখতে মানুষের মত কেন!? একজন বলে উঠল আশিক স্টেথো টা সুন্দর হইছে। বুঝলাম আমি যার গলায় ঝুলছি তার নাম আশিক আর আমি দেখতে আসলেই সুন্দর।
ওই যে দীর্ঘদিন ঘুমিয়েছি সেটা বোধহয় আমার জীবনের শেষ ঘুম ছিল। সারাদিন গলায় ঝুলিয়ে রেখে রাতের বেলা দুম করে টেবিলে কোন রকমে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার হাতে কি যেন একটা নিয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে আশিক , আশেপাশের কথাবার্তায় বুঝলাম এই জিনিসটাকে পড়া বলে। আর এই পড়া জিনিসটা আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলল! চিন্তা করেন সারাদিন একটা মানুষের গলায় ঝুলে থাকার পর রাতের বেলা এই পড়া শোনার অত্যাচার! আর একটু সময় জ্ঞান থাকলেও হতো, রাত নেই বিরাত নেই পড়তেই থাকে। এই কয়দিনে আমি নিশ্চিত হয়েছি এ মানুষ না, এখানে যারা আছে কেউ ই মানুষ না। এই জন্যই এদেরকে এরকম ডাক্তার ডাক্তার বলা হয়, এরা মানুষের উর্ধ্বে চলে গেছে, কোন মানুষের পক্ষে এত কষ্ট করা সম্ভব না!
সময় এর সাথে সাথে এই গলায় ঝুলে থাকাটাই আমার অনেক প্রিয় হয়ে উঠল। আবার যখন কোন অসুস্থ মানুষের হৃদয়ের লাব ডাব শব্দ শুনি, আমার মাধ্যমে যখন ডাক্তার বুঝতে পারে কি সমস্যা, তখন অসম্ভব ভালো লাগে। এত কিছুর মাঝে নতুন একটা জিনিস আবিস্কার করি আমি। আশিকের গলায় যখন ঝুলে থাকি তখন ওর হৃদয়ের শব্দটাও শুনি, আর এই শব্দটা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে চেইঞ্জ হয়। যখন খুশি হয় তখন এক রকম, কষ্ট পেলে অন্য রকম আর এই পরিবর্তনটা আমি বুঝি। আর এই জন্যই আশিকের সাথে থাকাতে এখন আর কষ্ট হয় না। গলায় ঝুলে থাকাটা আশির্বাদ মনে হয়। একদিনের ঘটনা, বেচারা সারারাত পড়েছে, কিন্তু সকালের দিকে দিলো ঘুম, এমন ঘুম আর উঠার নাম নেই। যখন উঠল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাড়াহুড়ো করে আমাকে কোন রকমে গলায় ঝুলিয়ে দৌড়। ওয়ার্ডে ঢুকার পর স্যার ওকে খুব বকা দিলেন, তখন আমি ওর হৃদস্পন্দন শুনছিলাম এই স্পন্দন গুলো কষ্টের। এইভাবে যখন মায়ের সাথে কথা বলে, যখন খুব খুশি হয়, আবার খুব কষ্ট পায়, ওর গলায় ঝুলে থাকলে আমি বুঝতে পারি। আর এটাও বুঝলাম আমি শুধুমাত্র আশিকের জন্য ব্যবহার্য কোন জিনিস নই। আমি ওর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছি। কি যেন বলেছিলো আমাকে তৈরি করার পর, ও হ্যা মনে পড়েছে ডাক্তারের থার্ড আই।
আশিক এখন পুরোদস্তুর ডাক্তার আর আমি আগের থেকে আরো বেশি সময় আশিকের গলায় ঝুলে থাকি। ডাক্তার হওয়ার পর আরো ২টা অনুভুতি আবিষ্কার করেছি আশিকের। রোগী সুস্থ হলে যে খুশিটা হয় ভিতরে ভিতরে। আর মানুষজন দোয়াও করে, এইতো সেদিন এক বৃদ্ধ মহিলা বলতেছিল অনেক বড় মানুষ হও বাবা! আমি তো হেসেই খুন! বাড়ন্ত বয়স তো শেষ, আর কত বড় হবে! আবার রোগী যখন মারা যায় তখনকার অবস্থা খুব ভয়ানক, আমি তো ভয় পেয়ে যাই, কষ্টে বুঝি বুকটা ফেটেই গেলো। এতদিন আশিকের সাথে থাকার ফলে বুঝলাম ডাক্তাররাও মানুষ, তাদের ও দুঃখ কষ্ট আছে, তাদের ও অসুস্থতা আছে , ইচ্ছা অনিচ্ছা ভালোবাসা সবকিছুই তাদের আছে। সেই সাথে আছে অপরিসীম ধৈর্য্য আর সাহস যা দিয়ে এই সব অনুভুতি চেপে রেখে চিকিৎসা করে যায়। এই যে দৃঢ় মনোবল এইটার কারনেই তারা মানুষের থেকে একটু আলাদা।
আজকের সন্ধ্যা টা অন্যান্য দিনের মতই স্বাভাবিক , সবে মাত্র রাউন্ড দিয়ে এসেছি আশিকের সাথে। এখন আমাকে টেবিলের উপর রেখে রেস্ট নিবে আশিক, এমনটাই হয় প্রতিদিন। হঠাৎ করে কে যেন এসে বলল, স্যার ইমার্জেন্সি! রেস্ট নেয়া হল না আর, আমাকে খামচে ধরে নিয়ে চলল আশিক। রোগির বুকের শব্দ শুনেই বুঝলাম অবস্থা ভালো না, আশিক ও বুঝলো! বললো, আপনাদের রোগীকে এখনই স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিতে হবে এখানে পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি নেই। রোগীর আত্মীয়ের একজন এসে বলল, এইটা হাসপাতাল না? এইখানে চিকিৎসা হবে না ক্যান? আপনে ডাক্তার না? চিকিৎসা করেন না কেন? আশিক অধৈর্য হয়ে বলল আপনারা এখানে নাটক করতে থাকলে রোগী কে বাচাতে পারবেন না! তাড়াতাড়ি নিয়ে যান! এই কথায় কি হল আমি জানি না। মানুষেরা হয়ত ভালো বলতে পারবে! ঐ লোকটা স্যালাইনের স্ট্যান্ড হাতে নিয়ে ধুপ করে আশিকের মাথায় বাড়ি মারল। এরপর সবাই মিলে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি লাথি মারা শুরু করলো। আমি আশিকের বুকের সাথে সাপটে আছি তাই স্পষ্ট ওর হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। এই যে এখন যেটা শুনছি খুব রাগ হলে এমন হয়, আস্তে আস্তে রাগ কমে যাচ্ছে, স্পন্দন চেঞ্জ হচ্ছে। এবার যেটা শুনছি এইটা যখন আশিকের বউ ফোন করে তখন এমন হয়। আবার চেঞ্জ হচ্ছে, এবার বোধহয় মায়ের কথা মনে পড়েছে। এখন আর কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না!! এরকম নিথর নিরব তো মৃত মানুষের বুকে পাওয়া যায়, আমি বোধহয় অকেজো হয়ে গেছি। আশিকের তো এমন হওয়ার কথা না! আশিক তো মানুষ না, কারন কোন মানুষ কে তো কোন মানুষ এভাবে মারতে পারে না!!
(বি.দ্র. গল্পটা ২০২০ সালের, খুলনায় এক ডাক্তার কে নির্মমভাবে হত্যা করার কাল্পনিক কথাচিত্র)