FriendsDiary.NeT | Friends| Inbox | Chat
Home»Archive»

একটি চিরকুমার সংঘের উত্থান

একটি চিরকুমার সংঘের উত্থান

*

হিমু সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সে আত্মহত্যা করবে‌। এই জীবন আর রাখবে না। তার জীবনে শুধু কষ্ট। কেউ তার দুঃখ বুঝে না। সবাই আত্মহত্যা করে দুঃখে, ডিপ্রেশনে, প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে, অভাবে, অপমানে। কিন্তু হিমুর আত্মহত্যা করতে চাওয়ার কারণ হচ্ছে বিয়ে না করতে পারা। অদ্ভুত হলেও সত্যি। হিমুর বয়স ঊনত্রিশ ছুঁই ছুঁই। তবুও আশ্চর্য কারণে হিমুর বিয়ে হচ্ছে না। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো তার বাবা। তার বাবা একজন আর্মি রিটার্ড অফিসার। ভীষণ বদমেজাজি। সব সময় নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আর হিমু ছোটবেলা থেকেই তার বাবাকে যমের মতো ভয় পায়। বড়বেলাও তাই।
+awkward+

বাবার সামনে দাঁড়ালে হাঁটু কাপে। আর যার কারণে হিমু বলতেও পারে না তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। মা’কে বলেও কোনো লাভ নেই। মা সারাদিন টিভির সিরিয়ালের বউ নিয়ে ব্যস্ত। আর এদিকে নিজের ছেলের বিয়ে করানো উচিত এটা তারা ভাবেই না। হিমু মা’কে বিয়ের ব্যাপারে বললে মা বলে, “এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে তুই নিশ্চয়ই আমার সংসারে আগুন লাগাতে চাচ্ছিস?”
হিমু বুঝতে পারলো না বিয়ে করার সাথে সংসারে আগুন লাগে কীভাবে। হিমু বলে, “কি বলছো মা? বিয়ে করলে সংসারে আগুন লাগে কীভাবে?”
“কি বলছি মানে? আমি নাটকে দেখেছি, ছেলেকে মা সুন্দর একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়। বিয়ের কিছুদিন পরে ঐ সুন্দরী বউ শ্বাশুড়িকে দেখতে পারে না। কথায় কথায় শ্বাশুড়িকে অপমান করে।”
“হোয়াট! কীসের সাথে কীসের সম্পর্ক? তার মানে তোমরা আমাকে বিয়ে দিবে না?”
“এত অধৈর্য্য হচ্ছিস কেন? বিয়ে তো আমরা তোকে নিশ্চয়ই দিব। কিন্তু তার জন্য তো একটা সুন্দর মেয়ে দরকার। দেখিস তোকে মোহরের মতো একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দিব। সময় হোক।”
“মোহরটা আবার কে?”
“ও মা! তুই জানিস না। যে নাটক দেখার জন্য আমি সারাদিন অপেক্ষা করি। অবশ্য জানবি কী করে তুই তো আর এসব ভালো জিনিস দেখিস না?”
+stare+

হিমু বুঝতে পারলো তার বাবা-মা তার বিয়ে সম্পর্কে একদম সিরিয়াস না। একমাত্র সন্তান সে। তবুও বাবা-মা বুঝার চেষ্টা করছে না। আত্নীয় স্বজনরা সব দূরে থাকে। কেউ সরাসরি বলে কেউ অন্যভাবে বলে। পাড়াপড়শিরাও পর্যন্ত বলে। কিন্তু তবুও হিমুর বাবা-মার এক কথা, “দিব, ভালো পাত্রী পাই। অবশ্যই দিব। সময় হোক।”
কিন্তু এই সময় হোক করতে করতে প্রায় বিয়ে করার সময় চলে গেল তবুও হিমুর বিয়ে হলো না। কারণ হিমুর বাবা-মার কাছে হিমু এখনো ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা। সন্তানরা নাকি বাবা-মার কাছে কখনো বড় হয় না। এর দৃষ্টান্ত উদাহরণ হিমুর বাবা-মা। অথচ হিমুর বয়স বেড়ে চুল পেকে যাচ্ছে। চুলও পড়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন পর টাকলা হতে সময় লাগবে না। ভুঁড়িও বেড়ে স্বাস্থ্য বেশ উন্নত হয়েছে। মোটা যাকে বলে। কিন্তু তবুও সে বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। মাঝে মাঝে হিমুর মামলা দিতে ইচ্ছে করে তার বাবা-মার নামে। বিয়ে না দেওয়ার মামলা। কিন্তু আফসোস এমন কোনো মামলা আমাদের দেশে নেই।
-ahp-

বাস্তব জীবনে হিমু খুব সহজ সরল। সবার সাথে মিলেমিশে চলে। অফিসে বিভিন্ন চাকরিজীবী তার সাথে মজা করে। তার থেকেও ভয়ঙ্কর হলো অফিসের কমবয়সী সুন্দরী কলিগরা। হিমুকে আঙ্কেল বলে ডাকে। হিমু এই লজ্জায় কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে পারে না। তবুও মাঝে মাঝে শিলা মেয়েটাকে তার ভালো লাগে। কী সুন্দর করে মেয়েটা সেজে আসে। হিমুর ইচ্ছে করে টুপ করে গলায় বিয়ের মালা পড়িয়ে দিতে। একদিন শিলা নীল রঙের শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে কালো টিপ মাথায় দিয়ে একদম পরীর মতো সেজে অফিসে আসে। হিমুর মনে ‘ও মেয়ে কাছে আসো না’ গানটা বাজতে থাকে। হিমু লাঞ্চ টাইমে শিলাকে বলে, “আমি পরী দেখিনি কিন্তু তোমাকে দেখেছি। নীল শাড়িতে কী সুন্দর লাগছে তোমায়। আচ্ছা তুমি এত সুন্দর কেন?”
শিলা মুচকি হেসে বলে, “কি যে বলেন না হিমু আঙ্কেল, ধন্যবাদ।” শিলার কাছ থেকে আঙ্কেল শুনে হিমুর মন ভেঙে যায়। হিমু রেগে গিয়ে শিলাকে বলে, “দূর একটু মজা করলাম। আসলে তুমি দেখতে একদম চাকমাদের মতো। ঐ যে চিকা আছে না? তার আকৃতি তোমার মধ্যে বিদ্যমান।”
শিলা রেগে গিয়ে হিমুর কানের নিচে বাজিয়ে চলে গেল। হিমু বুঝতে পারলো না বয়সের দিক থেকে যদি আঙ্কেল মনে হয় তবে চড় মারার সময় এরা বন্ধু ভাবে কীভাবে?
-why1-

হিমু সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিলিং ফ্যানে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে। আত্মহত্যার অনেক উপায় থাকলেও তার কাছে এটা বেটার মনে হলো। কারণ সে সাঁতার জানে না তাই নদীর জলে ঝাঁপ দিতে ভয় পায়। বিষ বা ক্যামিকেল খেয়ে আত্মহত্যা করতে বেশ সময় লাগে। এত সময় নিয়ে যন্ত্রণা ভোগ সে করতে পারবে না। ঘুমের ঔষধ খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু হিমুর মনে করে এই পদ্ধতি মেয়েদের মতো দুর্বল ছেলেদের জন্য। উঁচু থেকে লাফ দেওয়া যাবে না কারণ সে উঁচুতে ভয় পায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মরা যায়, কিন্তু এখানে বেঁচে গিয়ে পঙ্গু হবার আশঙ্কা আছে। কিন্তু সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে মরায় সে কোনো খারাপ দিক খুঁজে পেল না। বরং ঝুলে গেলেই খেলা খতম। এটা বর্তমানে বহুল প্রচলিত ট্রেন্ড। অনেক সেলিব্রিটি মানুষরাও এভাবে ফ্যানের সাথে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাই সে এটাকে এক শিল্প মনে করলো। ইতিহাসে সেই মনে হয় প্রথম ব্যক্তি যে বিয়ে না করতে পারার শোকে আত্মহত্যা করবে। হয়তো আত্মহত্যার ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে। জাতি তাকে চিনবে। হিমুর জন্য তার মতো বিয়ে না করা অসহায় ব্যাচেলর ছেলেদের বাবা-মা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিবে। জাতির কাছে একজন আইকন হিসেবে সে থাকবে। ভাবতেই হিমুর বুকটা ফুলে উঠছে।
+brain+

ফ্যানের সাথে ঝুলার জন্য তার প্রয়োজন একটা শক্ত মোটা দড়ি। কিন্তু ঘরে কোথাও দড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে কিছুদিন আগেও তার ঘরে ছিল। দড়ির জন্য বাবা-মাকে কিছু বলা যাবে না। তাই সে নিজে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে দড়ি পেল রান্নাঘরে। কিন্তু দড়ি দেখে ছেঁড়া। বেশ ভালো করে ছেঁড়া। হিমু বুঝতে পারলো ইঁদুরের কাজ এটা। এই দড়ি দিয়ে ফাঁস ঝুলানো সম্ভব নয়। তাই সে বাইরে গিয়ে দোকান থেকে মোটা দড়ি কিনে নিয়ে এলো। এরপর প্রয়োজন একটা টুল বা চেয়ার। হিমুর স্বাস্থ্য মোটামুটি অনেক। প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে হবে না। যদি ভেঙে বা পড়ে গিয়ে ব্যাথা পায়। না! সে মরার সময় কোনো রিক্স নিতে পারবে না। তাই সে ঠিক করলো কাঠের চেয়ার লাগবে। এখন ঘরের একমাত্র কাঠের চেয়ার হলো বাবার রুমে। বাবা দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। প্রতিদিন বাবা দুপুরের দিকে ঘুমায়। আজ দেরি করে ঘুমিয়েছে। হয়তো একটু আগে। দু ঘন্টা পর ঘুম ভাঙবে । তাই হিমু এতক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলো।
+late+

যতো যাইহোক আর সে কাঠের চেয়ার ছাড়া ফ্যানের সাথে ঝুলবে না। এমনিতেই জীবনটা তার বেদনা। আর বেদনায় জর্জরিত হতে চায়না। এজন্যই হিমু টানা আড়াই ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে লাগলো কখন তার বাবার ঘুম ভাঙে। এদিকে দুপুর পেরিয়ে বিকেল শেষ হয়ে গেল তবুও হিমুর বাবার ঘুম ভাঙলো না। ঘুম ভাঙলো আরো প্রায় এক ঘন্টা পর। মাগরিবের আজান দেওয়ার আধা ঘন্টা আগে। কিন্তু ঘর থেকে বাবা বের হলেন মাগরিবের নামাজের সময়। এদিকে হিমুর শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে। হিমু এরপর ধীরে ধীরে কাঠের চেয়ারটা নিয়ে আসলো। না আর দেরি করা যাবে না। সময় অনেক হয়েছে। বাবা আসার আগেই ঝুলে পড়তে হবে। মা সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। দুনিয়া কিয়ামত হয়ে গেলেও এখন তিনি ঘরের খবর রাখবে না। তাই এটাই মোক্ষম সুযোগ। তাই এখন সব রেডি। দড়ি গলায় দিয়ে চেয়ারে দাঁড়িয়ে সে প্রস্তুত।
+die1+

একটু পর ঝুঁলে যাবে। শেষে একবার বাবা-মার কথা মনে পড়লো। তারা কি কষ্ট পাবে? কিন্তু পরক্ষণেই দুনিয়ায় নিজের নাম পরিচিত করতে হবে বলে সে খুশি হয়ে গেল। চেয়ার ছেড়ে দিল। কিন্তু সিলিং ফ্যান ভেঙে হিমু ডিগবাজি খেয়ে পড়লো মেঝেতে। কোমরে পেল ব্যাথা। মোটা হলে যা হয় আর কি। পুরাতন ফ্যান । হয়তো ঝং ধরেছে। তাই ভেঙে পড়ছে। হিমুর শরীর রাগে জ্বলছিল। মরার জন্য এতো সমস্যা হবে সে ভাবতে পারেনি। মেঝেতে পড়ে হিমুর কোমর ভেঙে গেছে। নড়তে পারছে না। এদিকে ঘরের কেউ খোঁজ রাখছে না হিমু কী করছে। এসব ভেবে হিমুর মাথা রাগে ভনভন করছে। দুনিয়ার বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করে ফোন বেজে উঠলো। দেখে বন্ধু কানা মাসুদের ফোন। ফোন ধরার সাথে সাথে কানা মাসুদ ওপাশ থেকে বললো,
“বন্ধু তুই কই?” হিমুর মন দিয়ে একটা কুরুচিকর কথা বের হলেও দমন করে উত্তর দিল,
“বাসায়, কেন?”
“তোকে একটা কথা বলার ছিল?”
“মেয়েদের মতো ঢং না করে বল কী বলবি?”
“মারিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক সবাই মেনে নিয়েছে। আগামী মার্চে বিয়ে।”
হিমু আর কিছু বললো না। কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। রাগে ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললো। শুধু ফোন না মন চাচ্ছে ঘরে যা আছে সব ভেঙে ফেলতে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। বন্ধুমহলে কানা মাসুদ আর সেই ছিল অবিবাহিত। তাই হিমুর দুঃখ বুঝার জন্য সে ছিল একমাত্র সঙ্গী। কিন্তু এখন সেও নেই। দুনিয়াকে বড্ড স্বার্থপর মনে হচ্ছে। রাগে গরমে শরীর ভিজে যাচ্ছে‌। কিন্তু ফ্যান আকাশে না ঝুলে পড়ে আছে মাটিতে। নিজের প্রতি রাগ যেন বেড়েই চলেছে। তার দ্বারা আত্মহত্যা পর্যন্ত হচ্ছে না। নিজেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে গর্দভ মনে হচ্ছে। আর সব ক্ষোভ জমা হচ্ছে তার বাবার প্রতি। হিমুর এখন তার এক্স ***র কথা মনে পড়ছে। ***র বিয়ে হয়েছে আরো ৭ বছর আগে। *** বিয়ের আগে হিমুকে পালিয়ে গাছ তলায় সংসার পাতার কথা বলেছিল। কিন্তু হিমু তার বাবার ভয়ে তা করতে পারেনি। বিদায় কালে *** বলেছিল, “দেখিস এই জন্মে তোর বিয়ে হবে না। আমাকে ধোঁকা দেওয়ার শাস্তি তুই পাবি।” এখন হিমু বেশ বুঝতে পারছে ***র অভিশাপ কতোটা জোড়ালো ভেবে লেগেছে।
+xmed+

রাতে হিমুর বাবা আসার সাথে সাথে হিমু তার বাবার কাছে গেল। তার বাবা কাগজ নিয়ে কী জানি হিসেবে নিকেশ করছে। হিমুর আর সহ্য হচ্ছে না। আজ সে বলবে। আর নয়। লড়াই করার সময় এসেছে। হিমু তার বাবার সামনে গিয়ে সিংহের মতো বেশ চিৎকার করে বললো,“চৌধুরী সাহেব?”
হিমুর বাবা চশমার আড়ালে হিমুর দিকে তাকালেন। হিমু মনে ভয় এসে গেল এ কি করলো? বাবার নাম ধরে ডাকা উচিত হয়নি। কিন্তু পরক্ষণেই হিমু মনকে বুঝালো ভয়কে জয় করতে হবে। তাই আবার বললো কিন্তু বিড়ালের মতো মিনমিন করে,
“বাবা,একটা কথা বলতে চাই আপনাকে?”
“হু,বল?”
হিমুর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে ভয় হচ্ছে। কিন্তু আজ সে বলবে। চোখকান বন্ধ করে বেশ জোড়ে বললো,
“বাবা আমি বিয়ে করতে চাই?”
‘কী, আবার বল?’
“বাবা আপনার ছেলের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আপনারা দেখছেন না। আমি কি আপনার মতো বাবা ডাক শুনবো না?”
“কী! এত বড় সাহস তোর? বাপকে বিয়ের কথা বলিস?”
“আপনিই তো বললেন আবার বলতে। তাই বললাম। আমি আর মুখ বন্ধ করে থাকবো না। বিয়ে না দিলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
“তো বসে আছিস কেন? চলে যা। বেয়াদব কোথাকার।”
“বাবা আপনি এই কথা বলতে পারলেন? আমার কী কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে? নাকি আমাকে দত্তক নিয়েছেন?”
“দত্তক নিলেও তোকে কখনো নিতাম না। গর্দভ একটা। বাবার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?”
“বাবা একটা বিয়ে দিলে কী হয়? আপনার দাদু ডাক শুনতে ইচ্ছে করে না?”
“চুপ করবি নাকি লাঠি বের করবো। এখনো দুধের দাঁত পড়েনি সে চাইছে বিয়ে করতে।”
+db+

হিমুর এই কথা সহ্য হলো না। দুবার করে দাঁত পড়ে যাচ্ছে এখনো বলে দুধের দাঁত পড়েনি। এমনিতেই মাথা গরম আবার এইসব আজগুবি কথা। হিমু নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে বাবার ঘাড়ে কামড় দিয়ে বললো, “এই নেন, দেখেন দুধের দাঁত?” হিমুর বাবা আমেনা নাম ধরে দিল এক চিৎকার। চিৎকার শুনে দৌড়ে আসলো হিমুর মা। হিমুর মা’কে দেখে হিমুর মনে হলো আজ বুঝি রক্ষা নাই। বাবা লাঠি নিয়ে আসার আগেই মা’র সামনে দিয়ে হিমু ছুটলো। কিন্তু যাবার আগে দেখে টিভি চালু করা। হিমু রিমোট দিয়ে টিভি অফ করে রিমোটটা নিয়ে ছুটলো বাড়ির বাইরে। পিছনে বাবা লাঠি নিয়ে আসছে। যেভাবেই হোক আজ পালাতে হবে।
-runaway-

হিমু ট্রেনে করে পালিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না। কিন্তু সে হারাচ্ছে। এখানের কাউকে ভালো লাগে না। তাই সে পাড়ি জমাচ্ছে অজানায়। যেখানে কেউ তার জীবন নিয়ে সমালোচনা করবে না। ফোনটা আগেই ভেঙে ফেলেছে। তাই সে নিশ্চিত কেউ তার খবর পাবে না। হিমু নিজেকে মহাপুরুষ ভাবছে। কারণ অনেক মহাপুরুষরা বিয়ে না করে আজ তারা বিখ্যাত। হিমুরও এখন তেমন ইচ্ছে। সে এখন মহাপুরুষ হতে চায়। কিন্তু সবকিছু ঠিক ছিল হঠাৎ করে এক দম্পতি হিমুর সামনের সিটে বসলো। দম্পতিদের আবার এক ছোট্ট ছেলে। স্ত্রী দেখতে বেশ সুন্দর। না চাইলেও চোখ চলে যায় হিমুর। হিমু দেখলো ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে দম্পতির মাঝে রোমান্টিকতা ছুঁয়ে যাচ্ছে। সামনে যে একজন বসে আছে তা তারা খেয়ালই করছে না। কম বয়সী হয়তো এরা। তাই লাজলজ্জা কম।
একটু পর লোকটি স্ত্রীকে বলছে,
“তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে?”
“না।”
“কেন? কিছু খাবে?”
“আমার কিছু চাইনা। তুমি আছো পাশে আর কী বলো লাগে?”
এই বলে মেয়েটা লোকটার হাত আঁকড়ে ধরলো। লোকটির কোলে তাদের সন্তান। আহ্ কী সুন্দর দৃশ্য! কিন্তু হিমুর বুকে আগুন জ্বলছে। এত ভালোবাসা দেখে তার আর কিছু করার না থাকলেও দেবদাস হতে সে বোতলের ছিপি খুললো। বোতলে বিয়ার পানীয় থাকলেও বোতলটি বিয়ারের নয়। বাজার থেকে কিনে আনা পানি খাওয়া প্লাস্টিকের বোতল। হিমুর বন্ধু জেন্টেলম্যান তাকে দিয়েছে। জেন্টেলম্যানের আবার এসবের ব্যবসা আছে। দুঃখ ভুলতে জেন্টেলম্যানের কাছে গেলে জেন্টেলম্যান হিমুকে বলে, “তোমাকে বলেছিলাম, যেদিন তুমি বুকের হাহাকারে পুড়িবে, সেদিন তা নিভাতে আমার কাছেই আসিবে।”
+drunk+

হিমুর অন্য সময় জেন্টেলম্যানকে অসহ্য লাগতো। তার এই ব্যবসা হিমু সহ্য করতে পারতো না। আর তাই আজ সুযোগ বুঝে জেন্টেলম্যান টিটকারি মারছে। সব দুঃখ বুঝতে পেরে জেন্টেলম্যান হিমুকে বিয়ারের পানীয় প্লাস্টিকের বোতলে ভরে দিল। যেন কেউ সন্দেহ না করতে পারে। আর তাই হিমু এখন বোতলের মুখ খুলে এক চুমুক দিল। ইয়াক! কী বিশ্রী? প্রথম প্রথম খেলে যা হয়। হিমু চোখ বুঝে পিনিক অনুভব করতে লাগলো। আহ্ শান্তি। একটু পর সামনে দম্পতির বাচ্চাটা ‘পানি খামু’ বলে কেঁদে উঠলো। দুর্ভাগ্য তাদের কাছে পানির বোতল ছিল না। হিমুর কাছে পানির বোতল দেখে হিমুকে লোকটা বললো, “ভাই একটু পানি দিবেন? বাচ্চাটা খাবে।” ও শিট! লোকটার কথায় হিমু চমকে উঠলো। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এটা যে অ্যালকোহল তা বলা অসম্ভব। পরে ট্রেনে মার খেতে হবে। যদিও রাতে তেমন লোকজন নেই। তবুও একটা মাসুম বাচ্চাকে এসব দেওয়া অন্যায়। হিমু বললো,
“না। দিতে পারবো না।”
“আশ্চর্য! একটা বাচ্চা পানি খেতে চাইছে আপনি দিবেন না কেন? আপনার মনে কি মায়া দয়া নাই। বাচ্চাটা পানি পিপাসায় ছটফট করছে।”
“আমি এক কথায় বলি আমি পারবো না। সরি। আপনার বাচ্চা মরলে আমার কি?”
-sowhat-

হিমু পরে বুঝতে পারলো লোকটার সন্তানকে নিয়ে এভাবে মরার মতো অলক্ষুনে কথা শোনানো একদম উচিত হয়নি। লোকটা রেগে গিয়ে হিমুর সাথে পানির বোতল নিয়ে টানাটানি শুরু করলেন। যেভাবেই হোক তার পানির বোতল চায়। অবশেষে পানির বোতল নিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ানোর সাথে সাথে বাচ্চা বমি করে দিল। লোকটা বোতল থেকে বিশ্রী গন্ধ পেয়ে বুঝতে পারলো এটা মাদকদ্রব্য জাতীয় কিছু। তিনি জোর গলায় চেঁচাতে লাগলেন। ট্রেনের সব যাত্রীরা তা দেখার জন্য এলো। আর সাথে হিমুর গালে কিছু উপহার দিয়ে গেল। একটু পর স্টেশন মাস্টার আসলো। হিমুকে পরের‌ স্টেশনে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল। এদিকে অর্ধেক বিয়ার খাওয়া হিমুর ততক্ষণে নেশা হয়ে গেছে। দুনিয়া সব সবকিছু উল্টাপাল্টা লাগছে। হিমু একটা বেঞ্চে বসলো। পাশে একজন ভদ্রলোক চাদর গায়ে বসে আছেন। হিমু বুঝতে পারছে না এই গরমে চাদর গায়ে দেওয়া কোন ধরণের ভদ্রতা। হিমু লোকটাকে বললো,
“আজ খুব গরম তাই না?”
লোকটা বললো, “না।”
“ওহ, আপনার শরীরের তাহলে জ্বর?”
“না।”
“দেখেন দুনিয়ায় সবকিছু ঠিক নাই। মানুষ বড্ড খারাপ হয়ে গেছে। অন্যের দুঃখ বুঝে না। কিন্তু আমি আপনার দুঃখ বুঝতে পারছি আপনার মনে অনেক দুঃখ তাই না?”
“না।”
হিমু বুঝতে পারলো লোকটার প্রতিটি উত্তর ঐ-না এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। হিমুের মনে জিদ চেপে গেল। তাই সে আবার বললো,
“বলেন তো বিয়ে করা কি পুণ্যের কাজ?”
“হ!”
এইবার উত্তরে পজিটিভ কথা শুনে হিমুর মাথা খারাপ হয়ে গেল। হিমু ভেবেছিল সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় বিয়ে করা। কিন্তু এই লোকটির কথায় হিমু নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। সামনে একটা গাছের ডাল পেয়ে লোকটাকে মারতে শুরু করলো। লোকটা কয়েকটা মার খেয়ে বুঝতে পারলো এই নিশ্চয়ই কোনো পাগলের পাল্লায় পড়েছে। লোকটা উঠে দিল দৌর। হিমুও পেছনে দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে গালমন্দ করতে করতে ধরলো। লোকটার পিঠে এক রামকিল দিয়ে লোকটার পেটে বসে হিমু বললো,
“বল বিয়ে করা পুণ্যের কাজ নয়,বল হারামজাদা?”
লোকটা তুতলাতে তুতলাতে বললো, “হ,বিয়ে করা হারাম। বিয়ে করা হারাম।”
“ঐ ব্যাটা এক কথা তুই দুইবার বলোস কেন?”
এই বলে হিমু আমার মারতে শুরু করলো। লোকটা গগন ভেদ করে চিৎকার করে বললো,
“বাঁচাও, হেল্প! হেল্প!”
-helpme-

হিমু বসে আছে এক অন্ধকার ঘরে। সামনে একটা টেবিল। আর দুই পাশে দুটি চেয়ার। মাথার উপরে একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব মৃদু আলোয় জ্বলছে। টেবিলের ওপাশে বসে আছে ওসি কুদ্দুস আলী। হিমু কেন এখানে এলো তা বুঝতে পারছে না। ওসি কুদ্দুস আলী বললো,
“আগে বল তুই আমাদের ইনফর্মার কে কেন মারলি?”
হিমু এতক্ষণ পর বুঝতে পারলো যাকে মেরেছে সে একজন পুলিশের ইনফর্মার। হিমু চুপ করে রইলো। ওসি কুদ্দুস আলী আবার বললো, “আর তোর কাছে এটা কীসের রিমোট? কোথায় হামলা করার প্লান?”
হিমু ঢোঁক গিললো। কী বলবে বুঝতে পারছে না। হিমু বললো,
“আমি কিছু জানি না।”
“তাই না। সবকিছু খুলে বল? তোর এসবের পিছনে কে দায়ী?”
“আমার বাবা।”
“ও তার মানে তুই আর তোর বাবা জঙ্গিবাদে যুক্ত?”
“হোয়াট! তিনি একজন আর্মি রিটার্ড অফিসার।”
“তাই কী? আজ দেশরক্ষকরাও দেশখাদক। এসব বলে লাভ নেই। বল তুই কোনগ্রুপে সাথে যুক্ত?”
“জী, ব্যাচালর অবিবাহিত গ্রুপ।”
“মজা নিচ্ছিস আমাদের সাথে? মজা তোর পেছন দিয়ে বের করছি? হাবিলদার একে ডিম থেরাপি দেওয়া শুরু করো?”
+jail+

হিমু অনেক বুঝালো রিমোটটা টিভির। কিন্তু কিছুতেই তারা মানলো না। হিমুর মতো একটা মোটা গরু পেয়ে হাবিলদার শুধু মেরেই গেল। সকালে হিমুর বাবাকে হিমুর ব্যাপারে ফোন দেওয়া হলে হিমুর বাবা বলে, “ও আমার সন্তান নয়?” “হোয়াট! তাহলে আমরা কার ছেলেকে ধরলাম।”
“আমি জানি না।”
“আপনি জানেন না মানে? সে বলছে আপনি তার বাবা।”
এদিকে হিমুর মা হিমুর বাবার কানের কাছে এসে বলছে,
“ওগো, হিমুর কাছ থেকে একটু জেনে বলো না, রিমোটটা কোথায়?”
হিমুর বাবা বেশ জোরে ফোন কানে নিয়েই বললেন,
“চুপ কর। একদম কানের গোড়ায় দেব?”
ওসি কুদ্দুস আলী ধমক খেয়ে কিছুটা ভয় পেয়ে ফোনটা কেটে দিলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন হিমু নিশ্চয়ই কোনো জঙ্গি দলের সাথে যুক্ত। হাতে প্রমোশনের সুযোগ থাকতে পারে। তাহলেই তিনি বিয়েটাও করতে পারবে। এমনিতেই তাঁর বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। এবার সুযোগ এসেছেন। ওসি কুদ্দুস আলী চিৎকার করে বললেন,
“হারামজাদাটা কি এখনো কিছু বলেনি? দাঁড়াও আমি আসছি।”
+cop+

পরিশিষ্টঃ হিমুর বয়স এখন পঁয়ত্রিশ। সে আর এই জীবনে বিয়ে করেনি। সে এখন নিজেকে আরণ্যক বসুর ‘মনে থাকবে’ কবিতার সারমর্ম অনুসারে প্রায় বলে, ‘পরের জন্মে বয়স যখন ষোলো সঠিক, তখন আমরা বিয়ে করবো মনে থাকবে!’ বর্তমানে সে একটা সংঘের সাথে যুক্ত। সভাপতি পদে কাজ করে। সংঘের নাম ‘চিরকুমার সংঘ!’

[গল্পটি হিমুর বিশ্বস্ত সূত্র সাদমান আরিফ থেকে সংগৃহীত ও পরিমার্জিত]

*




15 Comments 693 Views
Comment

© FriendsDiary.NeT 2009- 2024